নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার মূল সন্দেহভাজন নূর উদ্দিনকে গ্রেপ্তারের পর ওই ঘটনার আগে-পরের বৃত্তান্ত জানিয়েছে পুলিশ।
মামলা তদন্তের দায়িত্বে থাকা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলছেন, এই ঘটনায় মোট ১৩ জন জড়িত ছিলেন, যাদের মধ্যে অন্তত দুজন ছাত্রী। তাদের একজন অধ্যক্ষের ভাগ্নি উম্মে সুলতানা পপি।
আর মাদ্রাসার ছাদে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেওয়ার সময় বোরকা পরা যে চারজন ছিলেন, তাদের একজন নূর উদ্দিনের বন্ধু শাহাদাত হোসেন শামীম বলে নিশ্চিত হয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
এই শামীম এক সময় প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলেন নুসরাতকে, কিন্তু নুসরাত সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন বলে জানান বনজ কুমার।
শনিবার ধানমণ্ডিতে পিবিআইয়ের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “তারা দুটি কারণে নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা করে। এর একটি হচ্ছে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে মামলা করে আলেম সমাজকে হেয় করা। আর অপরটি হচ্ছে শাহাদত হোসেন শামীমের প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা।”
সোনাগাজীর ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ এনেছিলেন নুসরাত। গত ২৬ মার্চ নুসরাতের মা শিরীনা আক্তার মামলা করার পরদিন সিরাজকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ।
ওই মামলা প্রত্যাহার না করায় ৬ এপ্রিল আলিম পরীক্ষার হল থেকে ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়া হয়। আগুনে শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যাওয়া নুসরাত ১০ এপ্রিল রাতে মারা যান।
দুই বছর আগে দাখিল পরীক্ষার সময়ও আক্রান্ত হয়েছিলেন নুসরাত। তখন তার চোখে দাহ্য পদার্থ ছুড়ে মারা হয়েছিল। ওই ঘটনায়ও নূর উদ্দিনকে সন্দেহ করা হয়।
নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার পরও ঘটনার হোতা হিসেবে তাকে সন্দেহ করেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। বোরকা পরা ওই চার হামলাকারীর মধ্যে নূর উদ্দিনও ছিলেন বলে ধারণা স্থানীয়দের।
ফেনীর সোনাগাজীর উত্তর চর চান্দিয়া গ্রামের নূর উদ্দিনকে শুক্রবার ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই।
ডিআইজি বনজ জানান, ঘটনার দুই দিন আগে নূর উদ্দিন কারাগারে গিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজের সঙ্গে দেখা করে আসেন। অধ্যক্ষ তাকে ‘একটা নির্দেশনা’ দেন।
সেই নির্দশনা অনুযায়ী নুসরাতকে আগুনে পুডিয়ে মারার পরিকল্পনা করা হয় বলে মনে করছেন তিনি।
এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করে আসার পরদিন মাদ্রাসার পশ্চিম হোস্টেলে সহপাঠী শাহাদত হোসেন শামীম, জাবেদ হোসেন, আব্দুল কাদের এবং আরেকজনকে নিয়ে বৈঠক করে নূর উদ্দিন।
“এই বৈঠকেই নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা এবং কার কী দায়িত্ব তা বণ্টন হয়।”
তার পরদিনই নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়া হয়।
ওই দিনের ঘটনার বর্ণনায় তিনি বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী চারজন বোরকা, নেকাব ও হাতমোজা পরে ছাদে অবস্থান নেয়। একজন ছাত্রী নুসরাতকে ছাদে তার বান্ধবী নিশাতকে মারধরের খবর দেয়, যাতে তাকে বাঁচাতে সে সেখানে ছুটে যায়। আর পাঁচজন মাদ্রাসার গেইটের বাইরে অবস্থান নেয় চারপাশে নজর রাখার জন্য।
ছাদে যে চারজন ছিলেন তারা সকাল ৭টার মধ্যেই মাদ্রাসায় ঢুকে পড়েন। তাদের মধ্যে দুজন কোচিংয়ে ছিলেন এবং দুজন ছিলেন বাথরুমে লুকিয়ে। তাদের কেউই পরীক্ষার্থী ছিলেন না।
এই চারজনের মধ্যে একজন ছিলেন শামীম। তাকে কেরোসিন ও বোরকা সরবরাহ করেছিলেন এই মাদ্রাসারই এক ছাত্রী, তিনি নিজেও ছিলেন নুসরাতকে আগুন দেওয়ার সময়।
বনজ কুমার বলেন, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সকাল ১০টায় পরীক্ষা শুরুর আগে নুসরাত কেন্দ্রে এলে বোরকা পরা এক ছাত্রী গিয়ে তাকে তার বন্ধু নিশাতকে ছাদে নিয়ে মারধর করা হচ্ছে বলে মিথ্যা খবর দেয়। ওই খবর দিয়েই সে তার দায়িত্ব শেষ করে। খবর শুনে নুসরাত ছাদে ছুটে যান।
“তখন ছাদে থাকা চারচজন নুসরাতকে ওড়না দিয়ে বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। এরপর তারা সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাইরে বেরিয়ে সবার সাথে মিশে যায়।”
বাইরে থাকা ওই দলের পাঁচজনও পরীক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সঙ্গে মিশে সটকে পড়েন।
এ ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার সন্দেহে মঙ্গলবার রাতে ফেনী থেকে অধ্যক্ষ সিরাজের ভাগ্নি উম্মে সুলতানা পপিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। নুসরাতের সহপাঠী পপি এর আগে মামার পক্ষ নিয়ে বিভিন্ন জনকে হুমকি-ধমকি দিয়েছিলেন।
নুসরাতকে আগুন দেওয়ার ঘটনায়ও তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে বলে বনজ কুমার মজমুদার জানিয়েছেন।
যে চারজন নুসরাতের গায়ে আগুন দিয়েছিল তাদের অন্তত একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানালেও তার নাম প্রকাশ করেননি পিবিআই কর্মকর্তা বনজ।
তবে তিনি বলছেন, শাহাদত হোসেন শামীম তাদের নজরদারিতে আছেন।
অপর আসামিদের মধ্যে অধ্যক্ষ সিরাজ (৫৫), ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদ আলম (৪৫), ওই মাদ্রাসার শিক্ষক আফছার উদ্দিন (৩৫), ছাত্র জোবায়ের আহমেদ (২০) ও জাবেদ হোসেন (১৯) এখন রিমান্ডে আছেন।
নুসরাতের ভাইয়ের দায়ের করা মামলার আট আসামির মধ্যে হাফেজ আবদুল কাদের নামে একজন এখনও পলাতক।
সূত্র, বিডিনিউজ২৪.কম